টেকসই মৎস্য উৎপাদনে মুক্ত জলাশয় সংরক্ষণ ও উন্নয়ন
মো: কাওছারুল ইসলাম সিকদার
বাংলাদেশ হলো পানি দ্বারা বেষ্টিত এক বৃহৎ বদ্বীপ। যার উপর দিয়ে অসংখ্য স্রোতধারা ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীন হতে উৎপন্ন হয়ে নদীরূপে দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদী পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য ছোট নদী ও এর শাখা-প্রশাখা জালের মতো বিস্তৃত হয়ে আছে বাংলার বুক জুড়ে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও চীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পানি সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ। এর কারণ বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয়; যেখানে শীতে বরফ জমে আর গ্রীষ্মে তা গলে নিকটবর্তী দেশগুলোর জমিকে করছে সবুজ শ্যামল এবং নদ-নদী খাল বিলকে করছে মাছের দ্বারা সমৃদ্ধ। বাংলার জন্য এ পানি আশীর্বাদ হলেও এর সহজপ্রাপ্যতার কারণে মূলত এটি বাংলার জন্য সৃষ্টিকর্তার কতবড় কৃপা তা আমরা অনুধাবন করতে পারিনি। তবে সময়ের পরিক্রমায় উজান হতে যখন দিন দিন পানির প্রবাহ কমে আসছে তখন আমরা পানির যে অত্যাবশ্যকীয় উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছি। বাস্তবিকভাবে পানিই হলো বাংলার প্রাণ ও সমৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উপাদান। এ কারণেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ ঘনত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীর এ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। পানির প্রাচুর্যতার কারণে বাংলাদেশ এক সময় অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য সম্পদ উৎপাদনে সমৃদ্ধ হলো। বর্তমানে বদ্ধজলাশয়ে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের চাহিদা মিটিয়ে মৎস্য আজ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
মুক্ত জলাশয় বলতে দেশের নদ-নদী, হাওড়-বাঁওড়, খাল-বিল এবং বর্ষায় প্লাবিত জমি যেখানে মাছ প্রাকৃতিক উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণ করে বড় হয় এবং বংশ বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশ পূর্বে অসংখ্য নদী-নালা, হাওড়-বাঁওড়, খাল-বিল, পুকুর-ডোবায় ভরপুর ও সমৃদ্ধ ছিল। এছাড়া দেশে রয়েছে কাপ্তাই লেক এবং সুন্দরবন এলাকাসহ অসংখ্য মুক্ত জলাশয়। দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ জেলার প্রায় ৪১১টি হাওড় রয়েছে। যার আয়তন প্রায় ৮০০০ বর্গকিলোমিটার। এ ছাড়া দেশে রয়েছে প্রায় ৮৭টি বাঁওড়। যার আয়তন প্রায় ৫৪৮৮ বর্গকিলোমিটার। বড় বাঁওড়গুলো যশোর অঞ্চলেই বেশি। বাঁওড়গুলো স্থানীয়ভাবে বিল হিসেবে পরিচিত। দেশে বিদ্যমান প্রসিদ্ধ বিলগুলো হলো চলন বিল, আড়াইল বিল, গোপালগঞ্জ, খুলনা বিল। ১৯ শতকের শুরুর দিকে চলন বিলের আয়তন ছিল প্রায় ১০৮৫ বর্গকিলোমিটার। যা বর্তমানে কমে ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার। তবে সারা বছর জলমগ্ন থাকে মাত্র ৮৫ বর্গকিলোমিটার। দেশে বিদ্যমান ৩১০টি নদীর দীর্ঘ প্রায় ২৪০০০ কিমি.। বর্ষায় দেশের ৫০-৭০% জমি প্লাবিত হয়। এ ছাড়া দেশে পুকুর-ডোবার সংখ্যা প্রায় ১.৩০ মিলিয়ন।
অপর দিকে বদ্ধ জলাশয় হলো পুকুর, ডোবা যেখানে মানুষ কৃত্রিমভাবে খাদ্য সরবরাহ করে অল্প জায়গায় নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাভবান হওয়ার জন্য মূলত বদ্ধ পানিতে মাছের চাষ করা হয়। বাংলাদেশের বদ্ধ পানিতে মাছ চাষে ব্যাপক সফলতা অর্জন হয়েছে। বিশেষ করে তেলাপিয়া ও পাঙ্গাশ মাছের উৎপাদনে প্রভ‚ত সাফল্য অর্জিত হচ্ছে। দেশে অভ্যন্তরীণভাবে মৎস্য সম্পদে স্বাবলম্বী হলেও মৎস্য উৎপাদনের উৎস পরিবর্তিত হচ্ছে দ্রæত। মৎস্যের চাহিদা মেটাতে মুক্ত জলাশয়ের চেয়ে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষে বিনিয়োগ ক্রমাগত বাড়ছে। দেশে মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ ৪০৪৭৩১৬ হেক্টর (৮৪.৭৫%) এবং বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ ৫২৮৩৯০ হেক্টর (১৫.২৫%)। ১৯৬০ সালে দেশে উৎপাদিত মৎস্যের মধ্যে ৯০% ছিল মুক্ত জলাশয়ের। যা ২০১০-১১ তে ৪২% এবং ২০১৪-১৫ তে মাত্র ২৮% নেমে এসেছে। ২০১৪-১৫ সালে দেশের মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৬,৮৪,২৪৫ মেট্রিক টন। যার মধ্যে মুক্ত জলাশয়ের মাছ ১০,২৩,৯৯১ (২৮%) মেট্রিক টন এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষের মাছ ২০,৬০,৪০৮ (৫৫%) মেট্রিক টন। যা সমুদ্রের মাছের পরিমাণ ৫৯৯৮৪৬ (১৬%) মেট্রিক টন। নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষের কারণে মাছের উৎপাদনের হারও অনেক বেড়ে গেছে। অপর দিকে মুক্ত জলাশয়ে সারা বছর পানির প্রবাহ না থাকায় এবং নদ-নদী, খাল বিলে শুষ্ক মৌসুমে পানির উচ্চতা কমে যাওয়ায় মাছের চলাচল ও বংশবৃদ্ধির জন্য অন্তরায় হয়ে পড়েছে। সে সাথে প্রতি বছর পলিতে ভরাট হয়ে দেশের নদীনালা, খালবিল, শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই এসব জলাশয়ের আয়তন প্রতিনিয়ত কমছে। মৎস্য বিচরণ ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে। সে সাথে জীবন ও জীবিকার জন্য অধিকমাত্রায় জেলেরা মৎস্য আহরণ করছে। এ ছাড়া সেচের জন্য ভূপরিস্থ পানি উঠিয়ে নেয়াসহ জমিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণেও মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন এবং উৎপাদনের হার ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। মুক্ত জলাশয় ও বদ্ধ জলাশয়ে উৎপাদন শতকরা হার টেবিলে দ্রষ্টব্য। মুক্ত জলাশয়ের মাছ অধিক নিরাপদ, সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। তাই এ মাছের চাহিদাও বেশি কিন্তু যোগান কম। বদ্ধ পানিতে উৎপন্ন মাছের তুলনায় মুক্ত জলাশয়ে উৎপন্ন মাছের বাজারমূল্যও কয়েক গুণ বেশি। মুক্ত জলাশয়ের অনেক প্রজাতি এর মধ্যে বিলুপ্ত প্রায়। শুকনো মৌসুমে একদিকে পানি কমে যাওয়া অপর দিকে ইজারা গ্রহীতা কর্তৃক সম্পূর্ণ মাছ ধরে বিক্রি করার কারণে মা মাছ সংরক্ষণও সম্ভব হচ্ছে না। মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমাদের বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে নদ-নদীর খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়ে সারা বছর পানির প্রবাহ রক্ষার জন্য খনন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে শুকনো মৌসুমেও মাছের চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত পানির উচ্চতা নিশ্চিত করা যায়। মা মাছের সংরক্ষণের জন্য মুক্ত জলাশয়ের নির্দিষ্ট পরিমাণ এলাকা সংরক্ষণ করতে হবে। যান্ত্রিক উপায়ে গভীরভাবে খনন করে মাছের জন্য হাওড়-বাঁওড়ের বিভিন্ন স্থানে অভয়াশ্রম তৈরি করতে হবে যেখানে সারা বছর পর্যাপ্ত পানি থাকবে এবং সংরক্ষিত স্থানসমূহে মাছ ধরা ও প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। উল্লেখ্য, পলি জমে ভরাট হওয়ার কারণে চলনবিলের পরিধি ১০৮৫ বর্গকিমি.। বর্তমানে সেখানে সারা বছর মাত্র ৮৫ বর্গকিমি. এলাকায় পানি থাকে। এটি কয়েক দশক পরে হয়তো শুকিয়ে যাবে। যদি না খনন করে বিলের পরিধি ও এর পানি সারা বছর সংরক্ষণ করা না হয়। এ বিল শুকিয়ে গেলে ওই অঞ্চলের মানুষ পানি ও মৎস্য উভয় সম্পদই হারাবে। সেইসাথে পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। তা দেশের সব মুক্ত জলাশয়গুলো সরকারি উদ্যোগে খনন করে পানি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে ইলিশ মাছ সংরক্ষণের জন্য যেমনি নির্দিষ্ট সময় নদীতে জেলেদের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে তেমনি মুক্ত সকল জলাশয়েও বর্ষায় কয়েক মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখতে হবে। যাতে করে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে এবং মাছের পোনা বড় হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়। বর্ষায় ৪-৬ মাস দেশের প্রায় ৫০-৭০% ভাগ এলাকা প্লাবিত থাকে। এ বিস্তীর্ণ এলাকায় ন্যূনতম দু-মাস যদি মাছ চাষ বন্ধ রাখা যায়, তবে মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন অনেক বাড়ানো সম্ভব হবে। সে সাথে মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক যদি দেশের নদ-নদী, হাওড়-বাঁওড় ও বিলগুলোতে বর্ষার শুরুতে মাছের পোনা ছাড়ে তবে মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদনের হারও বৃদ্ধি পাবে। বর্ষার শুরুতে দেখা যায় গ্রামের খাল বিলে খরা জাল দিয়ে মাছের পোনাগুলো ধরে ফেলা হয়। এটি রোধ করা না গেলে প্রাকৃতিক উৎসে মৎস্যর উৎপাদন বাড়ানো দুষ্কর।
দেশে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও মুক্ত জলাশয়ের এখনো বহু প্রজাতির মাছ বিদ্যমান এবং এসব মাছ যথামাত্রায় বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত সময় ও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। যাতে করে মা মাছ সারা বছর প্রতিটি মৎস্য বিচরণ ক্ষেত্রের অভয়াশ্রমে অবস্থান করতে পারে। উল্লেখ্য, বিশেষজ্ঞদের অভিমত অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়কে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার আওতায় এনে এসব জলাশয় থেকে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে বর্তমান সরকার হাওড়ের মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। যার ফলে মাছের উৎপাদন বাড়বে এবং গ্রামবাংলায় এ খাতে নিয়োজিত মানুষের আয়ও বাড়বে। সর্বোপরি দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। য়
অতিরিক্ত পরিচালক (উপসচিব), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, মোবাইল : ০১৫৫২৩৫৫৮৫৩, ই-মেইল : kawserul1173@gmail.com